স্বদেশ ডেস্ক:
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন, তার আগে নিমতলী ট্র্যাজেডি- কতশত প্রাণের বিনিময়েও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষ কিংবা বাড়ির মালিকদের। অধিক লাভের আশায় বেশিরভাগ বাসাবাড়িতেই দাহ্য রাসায়নিকে ঠাসা। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যাল, প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে নিতে জোর দাবি ওঠে। সরকারের উচ্চমহল থেকেও দেওয়া হয় একগাদা নির্দেশনা। কিছুটা সরব হয় দায়িত্বশীলরা। সময়ের আবর্তে সবই আবার হারিয়ে যায়। পরিস্থিতি মেনে নিয়ে ‘বোমা’র সঙ্গেই বাস করতে হয় সেখানকার অধিবাসীদের।
ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের আজ প্রায় দেড় বছর। কেমিক্যালের কারণে সৃষ্ট এ আগুন কেড়ে নেয় ৭১ জনের প্রাণ। এর পর বেশ নড়েচড়েই বসে কর্তৃপক্ষ। পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা সরাতে চলে তোড়জোড়। সব কেমিক্যাল গোডাউন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে স্থানান্তরের প্রকল্পেও লাগে হাওয়া। কিন্তু অতীতের মতো সেবারও মাঝপথে তা গতি হারায়। এমনকি রাজধানীর শ্যামপুরে ৫৪টি কেমিক্যাল গোডাউন করার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, সেটিরও কোনো অগ্রগতি নেই। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে নিমতলীর কেমিক্যাল গুদামে লাগা ভয়াবহ আগুনে ১২৩ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। দগ্ধ হন কয়েকশ মানুষ। এর পর থেকেই জোরালো দাবি ওঠে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও দোকান সরানোর।
সম্প্রতি মজুদ কেমিক্যাল থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় লেবাননের রাজধানী বৈরুত। এমন ঘটনার পর পুরান ঢাকাবাসীর পুরনো ক্ষতে শুরু হয় রক্তক্ষরণ। আবারও উঁকি দেয় বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা। তারা আর কোনো চুড়িহাট্টা কিংবা নিমতলী ট্র্যাজেডি চান না। তাই কেমিক্যাল গোডাউনগুলো দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠেছে নতুন করে।
গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ঢাকঢোল পিটিয়ে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর অভিযান শুরু করে। এর জন্য গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। উচ্ছেদ অভিযানের সময় বিভিন্ন স্থানে করপোরেশনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের। সেই অভিযানে ১৭০টি গোডাউন সিলগালা হয়েছিল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ভবন থেকে জব্দ হয় বিপুল কেমিক্যাল, জরিমানা করা হয় অনেক ভবন মালিককে। বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ওই বছরের ১ এপ্রিল থেকে থেমে যায় সেই অভিযান। দিন না পেরোতেই আগের অবস্থায় ফেরে পুরান ঢাকা। খুলে যায় সিলগালা করে দেওয়া গোডাউন, জমে ওঠে কেমিক্যাল ব্যবসা।
সরেজমিনে আরমানিটোলা, বংশাল, মাহুতটুলী, নাজিমউদ্দিন রোড, মিটফোর্ড ঘুরে অসংখ্য আবাসিক ভবনের নিচে রাসায়নিক পণ্য মজুদ থাকতে দেখা গেছে। আবার অনেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও দোকানের পাশেই রয়েছে খাবারের হোটেল। গ্যাসের চুলায় চলছে রান্নাবান্না। কোথাও কোথাও কেমিক্যাল গোডাউনের ওপরে রয়েছে মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টার। রয়েছে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। চুড়িহাট্টা ও নিমতলী এলাকাতেও আগের সেই চিত্র। ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচতলায় ফের বসেছে ‘মুক্তা প্লাস্টিক’-এর দোকান। সেখানকার একটি দোকানের মালিক আবদুল কাদের বলেন, ‘পুরান ঢাকায় অন্যত্র দোকান পাওয়া যায়নি। তাই এখানেই আবার বসেছি। তা ছাড়া সবাইকে একসঙ্গে স্থানান্তর না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।’
বংশাল এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকঢোল পিটিয়ে সিটি করপোরেশনের অভিযান দেখে বেশ আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু সেই অভিযান বন্ধ হওয়ার পর কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ একেবারেই থেমে গেছে। নতুন করে আর অভিযানও নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ উৎসাহে বাসাবাড়িতে দোকান-গোডাউন বানাচ্ছেন। সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকি। মনে হয় যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এলাকাবাসীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এখান থেকে সব কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া উচিত।’
এদিকে কেমিক্যাল গোডাউন রাখার দায়ে শহীদনগর, চকবাজারসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি এলাকার বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল। আবারও সেই ভবনগুলোর নিচতলা ভাড়া দেওয়া হয়েছে কেমিক্যালের গোডাউন বা দাহ্য পদার্থের কারখানাকে। এলাকাবাসী বলেন, বেশি টাকায় গোডাউন ভাড়া দিয়ে এখানকার বেশির ভাগ মালিকই থাকেন অন্যত্র। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে ভাড়াটিয়া কিংবা মধ্যবিত্তই প্রাণ হারান।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। আবার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ কিংবা সরকারের প্রদত্ত নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকবার তারা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুই দফা বৈঠকও হয়েছে। সেখানে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, তারা কোনো কেমিক্যাল রাখছেন না গোডাউনে। প্লাস্টিকসহ নানা ধরনের দ্রব্য তৈরির কাঁচামাল রাখছেন কেবল, যা দাহ্য নয়। তবে করপোরেশন সূত্র বলছে, এসব কাঁচামাল দাহ্য পদার্থ। যে কোনো সময় আবারও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হকের বরাত দিয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাসের আমাদের সময়কে বলেন, ‘ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর বিষয়ে দুই দফা মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ের সারসংক্ষেপ মেয়র দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। খুব দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে।’
২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা ব্যায়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে বিসিকের কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে আর্থের জোগান না থাকায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে গত নভেম্বরেই অতিরিক্ত ৮০০ কোটি টাকা চায় বিসিক। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে করোনার হানা। এখন পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণই শেষ হয়নি পুরোপুরি। অথচ প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। আবার শ্যামপুরে ৫৪টি কেমিক্যাল গোডাউন করার জন্য ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। সেটি চলতি বছরে চালু হওয়ার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে কোনো অগ্রগতিই নেই বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ন বলেন, ‘শ্যামপুরে ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জায়গায় অস্থায়ী গোডাউন দেওয়া হয়েছে। আপাতত দাহ্য কেমিক্যালগুলো এখন আনা হয়েছে। বিসিকে প্রকল্প চলমান। সেখান প্রস্তুত হলে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি ও জনসাধারণের ঝুঁকি চিরতরে শেষ হবে।’
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী আব্দুল জলিল অবশ্য বলেন, ‘পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে কোনো দাহ্য কেমিক্যাল নেই। এখানে যেসব গুদাম রয়েছে তার সবই সাধারণ কেমিক্যাল।’ তবে শ্যামপুরে অবস্থিত গোডাউনে সবাইকে স্থান দেওয়া সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা স্থায়ী সমাধান চান। আরও দুই বছর পর আবার বিসিকের পল্লীতে স্থানান্তর হওয়া লাগবে। কিন্তু এতদিন ধরে ব্যবসায়ীরা স্থান থেকে স্থানে ঘুরবে না। তাই সিরাজদিখানেই অস্থায়ীভাবে গোডাউন করা ভালো ছিল।’ এফবিসিসিআইয়ের কেমিক্যাল পারফিউম স্ট্যান্ডিং কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেনও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ঝামেলামুক্ত সমাধান চান। একস্থান থেকে বারবার স্থানান্তর হওয়াটা সমীচীন নয়। তাই পূর্ণাঙ্গ একটি পল্লী করে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’